ধৃতরাষ্ট্র উবাচ
রাজসিক যুদ্ধসাজে কৌরব পাণ্ডব
জড়ো হয় কুরুক্ষেত্রে, ধর্মচরাচর
আমি অন্ধ কৌতূহলী, বদ্ধ কুশীলব
সঞ্জয় বিশদে বলো, কী হলো তারপর ? //১//
সঞ্জয় উবাচ
মহারাজ, কুরুক্ষেত্রে বিষণ্ণ সবুজে
যুদ্ধমগ্ন দুর্যোধন সন্দিহান চোখে
পাণ্ডবের সৈন্যশক্তি আদ্যোপান্ত বুঝে
বললেন অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্যকে - //২//
"গুরুদেব, পাণ্ডবেরা সাজিয়েছে ঢেলে
পরাক্রমী সৈন্যদল, ক্ষত্রিয়বাহিনী
রচয়িতা ধৃষ্টদ্যুম্ন, দ্রুপদের ছেলে -
আপনার অন্যতম প্রিয় শিষ্য যিনি... //৩//
তাদের শিবিরে আছে বহু মহারথী
অর্জুন, ভীমের মতো চিরধর্মবাদী
আরও যারা যুদ্ধকার্যে জনপ্রিয় অতি
বিরাট, দ্রুপদ আর যুযুধান আদি... //৪//
ধৃষ্টকেতু ন্যায় যারা অস্ত্রশিল্পে সেরা
চেকিতান, কাশীরাজ দিগ্বিজয়ী বীর
পুরুজিৎ, কুন্তীভোজ, শৈব্য প্রমুখেরা
করেছেন আলোকিত পাণ্ডবশিবির //৫//
এই অস্ত্র-শিবিরের ত্রস্ত চারিধার
দুর্ভেদ্য ব্যূহের মতো সৈন্য দিয়ে ঘেরা
বীর্যবান উত্তমৌজা, যুধামন্যু আর
সুভদ্রাসন্তান এবং দ্রৌপদীপুত্রেরা //৬//
কিন্তু আরও পরাক্রমী কৌরবের ডেরা
শত্রুসৈন্য স্তব্ধ হবে অস্ত্রসজ্জা দেখে !
দ্বিজোত্তম, আমাদের সেনানায়কেরা
কোনও অংশে কম নয় পাণ্ডবের থেকে //৭//
মদীয় শিবিরে প্রভু আপনার মতই
কর্ণ - বিকর্ণ – কৃপ - ভীষ্ম পিতামহ -
অশ্বত্থামা - সৌমদত্তি মহাদিগ্বিজয়ী !
বিপক্ষ এঁদের কাছে কক্ষচ্যুত গ্রহ... //৮//
রয়েছেন আরও বহু সুদক্ষ সেনানী
বিশ্বাসভাজন তথা মৃত্যুভয়হীন
শত্রুপক্ষে বৃদ্ধি পায় অনর্গল গ্লানি...
শস্ত্রে তাঁরা সুসজ্জিত, প্রজ্ঞায় গহীন //৯//
আমাদের সৈন্যবল অনন্ত অসীম
ভীষ্ম পিতামহ দ্বারা পূর্ণ সুরক্ষিত
বিপ্রতীপে পাণ্ডবের অধিপতি ভীম
কে না জানে সেনাশক্তি নিতান্ত সীমিত ! //১০//
হে অয়ন, স্থিত হয়ে নিজ নিজ স্থানে
সুরক্ষায় শান দিন, তীক্ষ্ণ হোক দ্রোহ
চূর্ণ হবে দর্পপুষ্প বিপক্ষবিতানে
পূর্ণ সহায়তা পেলে ভীষ্ম পিতামহ..." //১১//
অক্ষয় নিয়তি নয় ভীষ্মের অজানা
তবুও সূচনা-শঙ্খ বাজালেন তিনি
প্রবীণ গর্জন দিলো দিগ্বিদিকে হানা...
উৎসাহে চঞ্চল হলো কৌরববাহিনী... //১২//
তৎক্ষণাৎ শত শত শঙ্খ - শিঙা - ঢাক
বেজে উঠলো যেন ঠিক যুদ্ধের মরশুম !
রক্তের চিৎকার কিংবা জল্লাদের ডাক
চরাচরে সৃষ্টি করলো শব্দ-কল্প-দ্রুম //১৩//
শ্বেত অশ্বযুক্ত এক অগ্নি-রথে চড়ে
চিরন্তন দুই বন্ধু শ্রীকৃষ্ণ, অর্জুন...
বাজালেন দিব্য-শঙ্খ ঘনশ্যামঘোরে
কেঁপে উঠলো ধিকিধিকি ভাগ্যের আগুন //১৪//
অর্জুনের দেবদত্ত দৈবসুরে আর
শ্রীকৃষ্ণের পাঞ্চজন্য মায়ামন্ত্রে বাজে
উঁচিয়ে ভয়াল শঙ্খ, পৌন্ড্র নাম যার
আতঙ্ক পাঠান ভীম সৈনিকসমাজে //১৫//
অতঃপর কুন্তীপুত্র জ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠির
বাজালেন ধর্ম-শঙ্খ অনন্তবিজয়
নকুল সুঘোষে আর সহদেব বীর
মণিপুষ্পকেই যেন সর্ববার্তাময় //১৬//
ইতিমধ্যে ধৃষ্টদ্যুম্ন, প্রাজ্ঞ কাশীরাজ,
শিখণ্ডী, বিরাট - যতো শ্রেষ্ঠ মহারথ
ছোটান সোচ্চারে তীব্র শঙ্খের আওয়াজ !
সর্বজিৎ সাত্যকিও দিলেন সঙ্গত... //১৭//
দ্রুপদ, পাঞ্চালীপুত্র, সুভদ্রাসন্তান
বাজালেন নিজ নিজ হর্ষময় শাঁখ
মহাকালে জমা হলো ধ্বংসের আজান
বহুদূরে গ্যালো উড়ে শকুন্তের ঝাঁক //১৮//
শঙ্খের নিনাদ দোলে সংগ্রামের সুরে
প্রতিধ্বনি পাক খায় কক্ষপথ ঘিরে
পাণ্ডব-চত্বর থেকে সামান্য অদূরে
হৃদকম্প শুরু হলো কৌরবশিবিরে //১৯//
পবন-রথের ধ্বজা এলোমেলো ওড়ে
ধনঞ্জয় ছিলা হাতে নিলেন প্রস্তূতি
বিপক্ষের শঙ্কা দেখে সম্মুখ সমরে
সারথিকে জানালেন আত্মঅনুভূতি - //২০//
অর্জুন উবাচ
হে মাধব, নিয়ে চলো জিজ্ঞাসার রথে
উভয়পক্ষের সেই সঙ্গম-প্রদেশে
নিজে চোখে দেখতে চাই ভিন্ন দুটি পথে
কারা কারা এসেছেন যুদ্ধ ভালোবেসে... //২১//
ঘন কৌতূহল যেন রণক্ষেত্রে তীর
সহস্র চাকার এই মৃত্যু উৎসবে
আমাকে করাবে স্নান কাদের রুধির ?
কাদের বিচ্ছেদ ছুঁয়ে সূর্যোদয় হবে ? //২২//
দুর্যোধন তুষ্ট হবে এই বাসনায়
যারা যারা যুদ্ধক্ষেত্রে সমবেত আজ
একান্তে তাদের দিকে চেয়ে থাকবো ঠায়...
হে সারথি, নিয়ে চলো সত্যের জাহাজ //২৩//
সঞ্জয় উবাচ
মহারাজ, পাওয়ামাত্র পার্থর আদেশ
শ্রীকৃষ্ণ হাসলেন মৃদু শান্ত অনুরাগে
চালিয়ে দুরন্ত রথ দক্ষ হৃষিকেশ
পৌঁছলেন দু-পক্ষের বিভাজনদাগে //২৪//
ভীষ্ম, দ্রোণ, রাজারাজড়া - সবার সম্মুখে
গভীর ইঙ্গিতসহ শ্রীকৃষ্ণ বলেন,
"ওই দ্যাখো কুরুপক্ষ তৈরি রণসুখে!
মগ্ন করো মনোযোগ, দৃষ্টি করো শ্যেন..." //২৫//
দুই পক্ষে ধেয়ে যায় অর্জুনের মন
যেদিকে তাকায় দ্যাখে যুদ্ধের রোশনাই
পৌত্র থেকে পিতামহ, অসংখ্য স্বজন...
শিক্ষক, মাতুল, পুত্র, বন্ধু আর ভাই... //২৬//
যোদ্ধার মুখোশে অন্ধ আত্মীয়ের দল
অন্ধকার নেমে আসে অর্জুনের মুখে
বিষণ্ণ চোখের কোণে ঝাপসা হয় জল
মালিন্য জানান পার্থ প্রিয়বন্ধুকে - //২৭//
অর্জুন উবাচ
অর্জুন উবাচ
এ-কেমন দৃশ্য বলো গোপেশ্বর তুমি ?
অস্ত্র হাতে বন্ধু আর আত্মীয়ের ভিড়
মনে হচ্ছে আমি একটা ক্লান্ত মরুভূমি
মনে হচ্ছে খসে পড়বে সমস্ত শরীর //২৮//
ভূতগ্রস্ত কেঁপে উঠছে রোমাঞ্চিত দেহ
যন্ত্রণায় জ্বলে যাচ্ছে চামড়া আর জিভ
পুড়ে যাচ্ছে ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, ভক্তি, স্নেহ...
হাত থেকে খসে পড়ছে অস্থির গাণ্ডীব //২৯//
আমি আজ মতিভ্রমে আন্দোলিত গাছ
কিম্বা কোনও উদ্ভ্রান্ত চন্দ্রাহত প্রেত
হে কেশব, ফুটে উঠছে শূন্যতার নাচ
ছুটে আসছে ভয়ঙ্কর অশনি সংকেত //৩০//
আত্মীয়নিধন মিথ্যে সংগ্রামের নামে !
দুটি হাত বন্ধুদের নোনারক্ত মাখা !
চাই না একাকী বাঁচতে রাজ্যের আরামে
চাই না সোনায় মোড়া বিজয়পতাকা //৩১//
যেসব বান্ধব ছাড়া রাজ্য-সুখ বৃথা
তারা আজ অর্ধমগ্ন, কলহে উন্মুখ
হে গোবিন্দ, এই যুদ্ধ ভাগ্যের ভণিতা!
এই যুদ্ধ অনর্থক, ঘৃণ্য, অহেতুক... //৩২//
সন্তানেরা টানটান অস্ত্র হাতে নিয়ে
পিতৃতুল্য প্রাজ্ঞরাও প্রতিক্রিয়াশীল
মৃত্যুভয়, প্রতিপত্তি বিসর্জন দিয়ে
দলে দলে দিকে দিকে সংগ্রামে সামিল //৩৩//
হে মধুসূদন, দ্যাখো মৃত্যুর উল্লাসে
জুটেছে শ্যালক, পৌত্র, শ্বশুর, মাতুল...
আমাকে এরাই যদি বধ করতে আসে
আমি থাকবো নিরুত্তর, কান্নায় মশগুল //৩৪//
তিন ভুবনের যত রাজ্য আছে সব
দিলেও এ-হত্যাকাণ্ডে জড়াবো না আমি
কীসের আনন্দ, বলো, কীসের গৌরব
কৌরবসেনানী যদি হয় অস্তগামী ? //৩৫//
শত্রু হোক, মিত্র হোক - হত্যা মানে পাপ
সন্ত্রাসে সন্ত্রাস বাড়ে - সে কথাও জানি...
যুদ্ধক্ষেত্র যদি হয় স্বজনে ছয়লাপ
জয়লাভেও মিশে যায় বিচ্ছেদের গ্লানি //৩৬//
সামান্য শৌর্যের বশে, যুদ্ধে অভিভূত
রাজ্যলোভে উত্তেজিত দুর্যোধনসেনা
বংশের ধ্বংসস্তূপ ডেকে আনছে দ্রুত
কী অনর্থ করছে এরা নিজেরা জানে না ! //৩৭//
পাপবোধে আস্তে আস্তে কুঁকড়ে যাচ্ছি আমি
ভবিতব্যে পাক খাচ্ছে সমস্ত আন্দাজ
যে প্রকল্পে লুপ্ত হবে সুবর্ণ আগামী
আমি ক্যানো সে কলঙ্কে নষ্ট হবো আজ ? //৩৮//
প্রজন্মের মৃত্যু হলে জন্ম নেবে ব্যূহ !
চর্যাচর্য মরে যাবে, মরে যাবে ভাষা
অভ্যেসের সঙ্গী হবে অশান্তিসমূহ
দুঃস্বপ্নে তাড়া করবে ধর্মজিজ্ঞাসা //৩৯//
পুরুষের উচ্চারণে মিথ্যে মিশে যাবে
প্রিয়তমা খুঁজে নেবে অন্য কোনও বাহু
বিকলাঙ্গ ছেলেবেলা সন্ততিরা পাবে
হৃদয়ের সৎ জ্যোৎস্না গ্রাস করবে রাহু ! //৪০//
নতুনেরা শিখে নিলে নগ্ন রাজনীতি
পৃথিবী অসহ্য এক নরকের মতো
অতীতের যত্নআত্তি, শেকড়ের স্মৃতি
নরকেই পচে মরে দুর্ভাগ্যবশত //৪১//
নিভে গেলে মাতৃবোধ, ধর্ম, ভালোবাসা
আগামী প্রজন্ম হয় হিংসার ব্যাপারী
সভ্যতাকে ধ্বংস করে ক্ষমতার ভাষা
দু-দণ্ড শান্তির খোঁজে কাঁদে নর-নারী //৪২//
ওগো জনার্দন, আমি আশৈশব জানি
শিকড় বিচ্ছিন্ন হলে জোড়া যায় না আর...
পৃথিবীকে মনে হয় ভগ্ন রাজধানী
যেন এক অফুরন্ত নরক গুলজার ! //৪৩//
নির্মম কুয়াশা জমলো আঁখিপল্লবে,
এ-কেমন পরিহাস বলো চিরসখা !
নিছক ঐশ্বর্য আর মুকুটের লোভে
বন্ধুদের রক্তে আঁকবো মৃত্যু উপত্যকা? //৪৪//
আমাকে বিষণ্ণ আর বর্মহীন বুঝে
আক্রমণ করে যদি সশস্ত্র কৌরব
হাসতে হাসতে মরে যাবো সুন্দর সবুজে
ছিন্ন ক'রে পিছুটান, কান্না, কলরব... //৪৫//
সঞ্জয় উবাচ
তপ্ত তার দুটি চোখ অভিশপ্ত আঁচে
কৌতূহলে ক্লান্ত তার ভারাক্রান্ত মুখ
নিজেকে উজাড় ক'রে শ্রীকৃষ্ণের কাছে
এ যে এক সময়হীন কাজে হাত দিলেন দেখছি। মন বলছে সময়হীন হয়ে থাকবেও।
ReplyDeleteপরের অধ্যায়ের অপেক্ষায়। প্রণাম।
porertar jonno opekhai roilam....
ReplyDeleteচমৎকার।
ReplyDeleteshambhavani yuge yuge
ReplyDeleteDarun likhchen ... chaliye jan
ReplyDeleteporer tar opekhkhay roilam
ReplyDeleteporer tar opekhkhay roilam
ReplyDeleteপরের টা আশা করছি আরো ভালো হবে
ReplyDeleteআহা! সাধু সাধু। পরবর্তী অংশ আপলোড করলে দয়া করে জানাবেন।
ReplyDeleteবেশ হল তো। আরো চাই-এর আবদার রইলো...
ReplyDeleteবেশ হল তো। আরো চাই-এর আবদার রইলো...
ReplyDeleteChai chai aar o chai...
ReplyDeleteভালো লাগলো। অন্তমিলের দায় না রাখলেও চলে।
ReplyDeleteপরবর্তী অংশের অপেক্ষায়।